মহানায়িকার ক্যারিয়ার
মহানায়িকা সুচিত্রা সেন সারাজীবনে মোট ৬২টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে হিন্দি চলচ্চিত্র ৮টি, বাংলা ৫৪টি। তিনি প্রথম অভিনয় করেন ১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ চলচ্চিত্রে। কিন্তু প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ১৯৫৩ সালের ‘সাত নম্বর কয়েদি’।
চলচ্চিত্রকেন্দ্রিক বাঙালির রোমান্টিসিজম উত্তম-সুচিত্রাকে ঘিরে। উত্তম কুমার বিদায় নিয়েছেন অনেক আগেই। তবুও রোমান্টিসিজমে চিড় ধরেনি। বরং সুচিত্রা নিজেকে আড়াল করে জিইয়ে রেখেছিলেন। চন্দনের চিতায় ভস্ম হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি আড়াল ভাঙেননি। তাই বাঙালির মনে সুচিত্রা সেই চিরচেনা রূপেই আছেন। চামড়ায় বলিরেখা পড়েনি, হাসির ঢেউয়ে পড়েনি ভাটা, মন্থর হয়ে যায়নি তার তরঙ্গ। আমাদের গ্রেটা গার্বো তিনি। শিখিয়ে গেলেন, মৃত্যুর পরও কীভাবে ভক্তদের মনে মায়া খেলা নিত্যনতুন রাখতে হয়।
উত্তম কুমার বিদায় নিয়েছিলেন ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই। ভেঙে গেল উত্তম-সুচিত্রা জুটি। কিন্তু সুচিত্রা চেয়েছিলেন কালের কাছে নিজেদের জুটিকে চির নতুন রাখতে। তাই তো উত্তমের বিদায়ের পর নিজের ঘরে কপাট দিলেন চিরদিনের জন্য। অবশ্য সবার আগ্রহে একবার তিনি কপাট খুলেছিলেন। ১৯৮২ সালের কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সামান্য সময়ের জন্য গিয়েছিলেন। ব্যস ওইটুকুই। আর কোনোদিন দেখা যায়নি তার মুখ। এরপর থেকে বাঙালির কল্পনায় সুচিত্রা হেসেছেন।
নিজেকে আড়ালে নিয়ে সুচিত্রা হয়েছেন আরও কাঙ্ক্ষিত। তাকে দেখার জন্য সবার আগ্রহ বাড়তে থাকে। তাই তো তিনি আড়াল হওয়ার বছর কয়েক পরে হঠাৎ একটা খবর এলো, জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য ছবি তুলতে আসবেন সুচিত্রা। মুহূর্তে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। ভক্ত-সাংবাদিকদের ভিড় মিছিলে পরিণত হয়। সবার উৎকণ্ঠা- মহানায়িকা কখন আসবেন?
সবার অপেক্ষা মধ্যরাতে গিয়ে ঠেকে। কিন্তু নায়িকার দেখা কেউ পেল না। সবাই ঘরে ফিরে যায়। পরে খবর প্রকাশ হয়_ সুচিত্রা গোপনে এসে ছবি তুলে চলে গেছেন।
নিজেকে অন্তরালে রাখার এই চেষ্টা সুচিত্রা করে গেছেন মৃত্যু পর্যন্ত। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েও তিনি মুখ ঢেকে রাখতেন। আর এ জন্য তিনি অনেক বিসর্জনও দিয়েছেন।
২০০৫ সালে সুচিত্রাকে আজীবন সম্মাননায় দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়। কিন্তু আড়াল ভেঙে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নিতে তিনি রাজি হননি। পুরস্কার থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন তিনি। তবুও আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিল ভারত সরকার। রেয়াজ ভেঙে গোপনে তার হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবুও রাজি হননি মহানায়িকা।
সুচিত্রার আড়াল জীবন নিয়ে তার স্বজনরাও কখনো মুখ খুলেননি। সুচিত্রা কীভাবে ঘুমান, কি করেন, কি খেতে ভালোবাসেন, অবসর কীভাবে কাটে- এমন অগণিত প্রশ্ন স্বজনদের শুনতে হয়েছে। সবসময়ই তারা বিনয়ী হাসি দিতে এড়িয়ে গেছেন। যে আড়ালে থাকতে ভালোবাসেন তাকে সবার সামনে আনতে চাননি তারা। সম্মান দেখিয়েছেন। তা ছাড়া সুচিত্রার কঠিন বারণ ছিল, টুঁ-শব্দ করার ব্যাপারে। আর তাই সংবাদ মাধ্যমগুলো সুচিত্রার খবরের জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও তার নাগাল পায়নি। যারা সুচিত্রার দেখা পেতেন তারা ছিলেন সবসময়ই চুপ।
বালিগঞ্জের বাড়িটিতে একা থাকতেন সুচিত্রা। মেয়ে নাতনীরা নিজেদের মতো করে আলাদা। বিভিন্ন সময় পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায় বছর কয়েক আগেও ঘরে বসে টিভিতে নিজের ছবিগুলো আগ্রহ নিয়ে দেখতেন। তবে গত কয়েক বছর রামকৃষ্ণ মিশনের হেডকোয়ার্টার বেলুর মঠে গিয়ে অনেক সময় পূজা-অর্চনা করে সময় কাটাতেন। কিন্তু কেউ চিনত না। অন্য আট-দশজন মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে তিনি নিজের প্রার্থনা সেরে চলে এসেছেন। অনেকের সঙ্গে শরীরে হালকা ধাক্কাও লেগে থাকতে পারে। কিন্তু সেই অভাগা কখনো জানলেন না, কার শরীর স্পর্শ করে ভ্রূক্ষেপ না করে এগিয়ে গেলেন তিনি। জানলে সেটা হতো তার আজন্মের আক্ষেপ।
সুচিত্রাকে নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। অনেকেই অনেকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন নিজেকে আড়ালে রেখে রোমান্টিসিজম ধরে রাখার ব্যাপারে। কিন্তু গবেষকদের গবেষণা সুচিত্রার মনোযোগে চিড় ধরাতে পারেনি। তিনি কখনো জানতেও চাইতেন না, মানুষ তাকে নিয়ে কি ভাবছে, কি বলছে।
সম্প্রতি সুচিত্রার বড় নাতনি অভিনেত্রী রাইমা সেন একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘তার [সুচিত্রা] মধ্যে মানুষের কৌতূহল জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। কারণ তিনি নিজের সেই তারকা সত্তাকে ঘুম পারিয়ে রেখেছেন। যদি তার মধ্যে কৌতূহল থাকত, তবে তো তিনি সবার সামনেই থাকতেন। কখনো আড়াল হতেন না।’ তিনি আরও বলেন, ‘নিজেকে আড়ালে রাখা এত সহজ নয়। সব খ্যাতির মোহ ছেড়ে, মানুষের ভালোবাসা, সম্মান দূরে ঠেলে নির্মোহ হয়ে লুকিয়ে থাকতে কতটা নির্লোভ হতে হয়, তা তাকে দেখে আমি বুঝেছি। তিনি এটা করেছেন, কারণ তিনি চান অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন সবার মনে বেঁচে থাকুক, ব্যক্তি সুচিত্রা সেন নয়। তিনি তা পেরেছেন।’
কলকাতার স্বনামধন্য সাহিত্যিক কণা বসু মিশ্র এক স্মৃতিকথায় একটা ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন। কলকাতা দূরদর্শনে ‘সাত পাকে বাঁধা’য় সুচিত্রা সেনের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে ফোন করেছিলেন কণা। কণা ফোনে তাকে বললেন, সাত পাকে বাঁধায় আপনার অভিনয় দেখে আমি আপ্লুত। সুচিত্রা সেন কণাকে থামিয়ে বললেন, ‘ওটা অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন, আমি নই’।
অভিনয় ক্যারিয়ারে একবার সাক্ষাৎকারে সুচিত্রা বলেছিলেন, ‘আমাকে শুধু স্ক্রিনেই দেখা যাবে, কারণ আমি একজন অভিনেত্রী।’
সত্যিই তাই। বাঙালি পর্দায় সুচিত্রাকে দেখেই রোমান্টিসিজমে ভুগবে যুগের পর যুগ। সুচিত্রা কখনো মলিন হবে না_ নিজেকে আড়ালে রেখে এটাই তার অর্জন।