পাক-ভারত ম্যাচ এমনই হয়!
উদযাপনের এই ভঙ্গিটা খুব পরিচিত। দুই হাত তুলে নিষ্কম্প মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে যাবেন তিনি। একে একে সতীর্থরা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরবেন তাঁকে।
পার্থক্য বলতে, বোলিংয়ে উইকেট বা দুর্দান্ত কোনো ক্যাচ নেওয়ার পরই বেশি দেখা যায় এই দৃশ্যটা। কাল হাসিমুখ শহীদ আফ্রিদির এক হাতে ব্যাট, আরেক হাতে হেলমেট। কিছুক্ষণের মধ্যেই হারিয়ে গেলেন পাকিস্তানি দলের জটলায়। সেই জটলার মাথায় উঁচিয়ে ধরা ব্যাটটা তখনো দৃশ্যমান।
যেটিকে প্রতীকীও বলতে পারেন। পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচের ভাগ্যকে পর পর দুই বলে দুই ছক্কায় পাকিস্তানের দিকে স্থির করে দিয়েছে তো ওই ব্যাটই।
গত পরশু ওয়াসিম আকরাম ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্যের দিকটার ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন। ঐতিহাসিক তাৎপর্য, আবেগ-টাবেগ এসব তো বলারই কথা। বললেনও। এরপর শুধুই ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই দ্বৈরথের মাহাত্ম্য বোঝালেন। এই দুই দেশ মুখোমুখি হলে ‘একতরফা ম্যাচ’ বলে কিছুর অস্তিত্ব থাকে না। প্রায় সব ম্যাচই শেষ হয় শেষ বল বা শেষ ওভারে। আবারও সেই সত্যের সাক্ষী কালকের মিরপুর স্টেডিয়াম।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কতবারই না রং বদলাল এই মহারণ! সবকিছুর শেষে সময় এসে থমকে দাঁড়াল শেষ ওভারের আগে। ১০ রান চাই পাকিস্তানের, হাতে দুই উইকেট। যে সাঈদ আজমল তাঁর ‘দুসরা’য় ব্যাটসম্যানদের নিয়মিতই ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ান, এবার সেই অভিজ্ঞতার শিকার তিনি নিজে। অশ্বিনের ‘ক্যারম বলে’ পায়ের পেছন দিয়ে বোল্ড!
আধঘণ্টা আগেও যে ম্যাচ ‘ভারত-পাকিস্তান’ নামের ‘কলঙ্ক’ হয়ে পাকিস্তানের অনায়াস জয়ের পূর্বাভাস দিচ্ছিল, সেটিতে তখন ভারতই ফেবারিট। উইকেটে শেষ ব্যাটসম্যান জুনাইদ খান। নন স্ট্রাইকিং প্রান্তে অসহায় চোখে তাকিয়ে শহীদ আফ্রিদি। জুনাইদ ঠেকিয়ে গেলেও তো হচ্ছে না, তাঁকে তো স্ট্রাইক পেতে হবে!
অশ্বিনের আরেকটি ‘ক্যারম বল’ একটু শর্ট পড়ে যাওয়ার সুযোগে জুনাইদ সেটিকে স্কয়ার লেগে ঠেলেই পড়িমরি করে ছুটলেন। ৪ বলে ৯ রান—ধেৎ, আফ্রিদি এসব হিসাব-নিকাশকে পাত্তা দেওয়ার লোক নাকি! পরের দুই বলেই দুটি ছক্কায় ভারতকে ম্যাচ থেকে উড়িয়ে ফেললেন মাঠের বাইরে। হয়তো টুর্নামেন্ট থেকেও।
দুই বছর আগে এই এশিয়া কাপেই দুই দল যখন মুখোমুখি হয়েছিল, বিরাট কোহলি একাই লিখে দিয়েছিলেন ম্যাচের ভাগ্য। দুই সেঞ্চুরিতে পাকিস্তানের ৩২৯ রানের পাহাড়ও ভারত হেসেখেলে পেরিয়ে গিয়েছিল কোহলির ১৮৩ রানের অতিমানবীয় ইনিংসে।
কালকের ম্যাচ শুরুর আগে কোহলির সেই সুখস্মৃতি মনে পড়ারই কথা, নিশ্চয়ই মনে পড়েছে পাকিস্তানেরও। মোহাম্মদ হাফিজের বোধ হয় সবচেয়ে বেশি। সেই ম্যাচে ব্যাটিংয়ে ১০৫ করার পর ভারতীয় ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই উইকেট এনে দেওয়ার পরও পরাজয়ের হতাশায় পোড়ার দুঃস্মৃতি তিনি কীভাবে ভোলেন!
এত দিনে সেই দুঃখে প্রলেপ পড়ল। সেই এশিয়া কাপ, সেই মিরপুর…কোহলির গল্প এবার মাত্র ৫ রানেই শেষ। আর ব্যাটে-বলে পাকিস্তানের জয়ের নায়ক মোহাম্মদ হাফিজ। পাকিস্তানের আনন্দের ক্যানভাসে তুলির শেষ আঁচড়টা দিয়েছে আফ্রিদির ব্যাটই, তবে হাফিজই তো সাজিয়ে-গুছিয়ে দিয়েছেন সেটিকে। তাঁর আনন্দটা আরও মধুর হয়েছে ম্যাচের শেষ আধঘণ্টা প্রবল উদ্বেগে কাটায়।
শোহেব মাকসুদের সঙ্গে তাঁর ৮৭ রানের পঞ্চম উইকেট জুটি ম্যাচের গা থেকে অনিশ্চয়তার সব রং প্রায় মুছেই দিয়েছিল। অশ্বিনের ক্যারম বলে হাফিজের বিদায় ফিরিয়ে আনল ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের চিরন্তন সেই উত্তেজনা। আবার যা মনে করিয়ে দিল, এই ম্যাচে শেষ হওয়ার আগে শেষ বলতে নেই।
পরের ওভারে মাকসুদ রান আউট। পাকিস্তানের জয় তখনো ৪৩ রান দূরে, বল বাকি ৩২টি। রান-বলের এসব হিসাবকে শহীদ আফ্রিদি বরাবরই তুচ্ছ জ্ঞান করে এসেছেন। কিন্তু এই পাঠান কখন কী করবেন, নিজেই তো তা জানেন না! ব্যাটিংয়ে নামতেই প্রেসবক্সে ভারতীয় সাংবাদিকেরা বলতে শুরু করলেন, আফ্রিদি তো ফর্মে নেই।
কথাটা মিথ্যে নয়। তবে এর চেয়েও বড় সত্যি, আফ্রিদির ক্ষেত্রে ফর্ম জিনিসটা গল্পের চড়ুইপাখির মতো ফুড়ুৎ করে আসে-যায়। ১৮ বলে অপরাজিত ৩৪ রানের এক ঝড়ে আবারও সেটি মনে করিয়ে দিলেন অনেক ভারত-পাকিস্তান অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এই সৈনিক।
ম্যাচটাকে বলা হচ্ছিল ভারতীয় ব্যাটিং বনাম পাকিস্তানি বোলিংয়ের লড়াই। ম্যাচের প্রথম অর্ধেকটায় সেই লড়াই, যেটি শেষ হলো সমতায়। ভারত করল ২৪৫। ওয়ানডেতে এসব স্কোরকে বলা হয় ‘ফাইটিং স্কোর!’ এমন বড় কিছু নয়, আবার একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতোও নয়। ম্যাচের নির্ধারক তাই দুই দলের দুর্বল দুই বিভাগের লড়াই। পাকিস্তানের ব্যাটিং বনাম ভারতের বোলিং। প্রথমটি শরতের আকাশের মতো ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। গত কিছুদিনে দ্বিতীয়টির অবশ্য এই দুর্নাম নেই। সেটি ধারাবাহিকভাবেই বিবর্ণ।
৪ উইকেটে ২০০ থেকে ৩৬ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ম্যাচটা জমিয়ে তোলার কৃতিত্বটা ভারতীয় বোলিংয়ের, নাকি পাকিস্তানের ব্যাটিংয়ের, এ নিয়ে তর্ক তাই হতেই পারে। যেটির মীমাংসা হওয়াটা একদমই জরুরি নয়। শেষ পর্যন্ত নিরপেক্ষ দর্শকের জন্য স্বপ্নের এক ওয়ানডে ম্যাচ তো এটির সৌজন্যেই।
নিরপেক্ষ দর্শক! তেমন কেউ ছিল নাকি গ্যালারিতে! খেলা শুরুর ঘণ্টা তিনেক আগে থেকে স্টেডিয়ামমুখী রাস্তাঘাটে যে তোড়জোড়, গ্যালারিতে সেটির প্রতিফলন নেই। এক-তৃতীয়াংশের বেশি চেয়ার প্রথমে রোদে পুড়ল, পরে ভিজল শিশিরে। ওয়াসিম আকরাম আগের দিন কানায় কানায় পূর্ণ গ্যালারি আশা করেছিলেন। সেটি না হওয়ায় একটু অবাকই তিনি। সেই গ্যালারি অবশ্য সত্যিকার অর্থেই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে থাকল। এই ভারতীয় সমর্থকেরা চিৎকারে এগিয়ে যাচ্ছে তো পরক্ষণেই পাকিস্তানি সমর্থকেরা!
‘ভারতীয়’-‘পাকিস্তানি’ লিখছি বটে, কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগই তো বঙ্গসন্তান! সমর্থনে আপত্তি নেই, জমজমাট খেলাটিকে বরং আরও বর্ণিলই করে তুলল তা। কিন্তু বাংলাদেশের এত এত মানুষের ভিনদেশি পতাকা আর সেই পতাকার রঙে মুখ আর শরীর রাঙিয়ে মাঠে আসাটা যে বড় চোখে লাগল!
তাঁদেরকে সবিনয়ে একটা প্রশ্ন বোধ হয় করাই যায়—আর কোনো দেশের মানুষের মুখে-শরীরে কি লাল-সবুজ দেখেছেন কখনো!
ভারত: ৫০ ওভারে ২৪৫/৮
পাকিস্তান: ৪৯.৪ ওভারে ২৪৯/৯
ফল: পাকিস্তান ১ উইকেটে জয়ী